আমিরাত প্রবাসী শফিউল ইসলাম পলাশের সফলতার গল্প
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। আরবিতে বলা হয় দাওলাত্ আল্-ঈমারাত্ আল্-আরবিয়াহ্ আল্-মুত্তাহিদাহ্। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত সাতটি স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি ফেডারেশন। এগুলি একসময় ট্রুসিয়াল স্টেটস্ নামে পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালে দেশগুলি স্বাধীনতা লাভ করে। প্রতিটি আমিরাত একটি উপকূলীয় জনবসতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত এবং ঐ লোকালয়ের নামেই এর নাম। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাতটি আমিরাতের নাম হল আবুধাবি, দুবাই, শারজাহ্, আজমান, ফুজাইরাহ, রাস আল খাইমাহ এবং উম্ম আল কোয়াইন। আবুধাবি শহর আমিরাতের রাজধানী আর দুবাই হচ্ছে বৃহত্তর বাণিজ্যিক শহর। দেশটির বাণিজ্যিক শহর দুবাইতে ১৯৯৫ সালে আসেন বাগের হাটের মোহাম্মদ শফিউল ইসলাম পলাশ। অত্যন্ত সাধারণ মানের একজন শ্রমিক হিসেবে তার আগমন হলেও কঠোর পরিশ্রম, মনোযোগ আর ইচ্ছে শক্তি তাকে এনে দিয়েছি স্বয়ং স্রষ্টার প্রদত্ত ভাগ্য চাবি! আপন পরিশ্রমে তিনি পান নিয়তির প্রশস্ত হাতের ছোঁয়া। ব্যবসায় লেগে থাকা মনোভাব চূড়ান্ত সফলতার দিকে এগিয়ে নিচ্ছে তাকে। শুধুমাত্র টিকে থাকার সংগ্রাম করে যাওয়া মানুষটি আজ হয়েছেন সতেরটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ছড়িয়ে আছে আমিরাতের প্রত্যেকটি প্রদেশে। মূলত ব্যবসা করছেন গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে। এছাড়াও আছে ফ্যাক্টরি, ক্যাটারিং ও হোটেল ব্যবসা। ২০১৮ সালে ১ কোটি ৮৪ লাখ ডলার রেমিটেন্স প্রেরণ করে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শ্রেষ্ঠ রেমিটার্স সম্মাননাও লাভ করেন তিনি।
মোহাম্মদ শফিউল ইসলাম পলাশের জন্ম ১৯৬৮ সালে বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলার গাড়ফা গ্রামে। বাবা মৃত আব্দুস সাত্তার ও মাতা মৃত শাফিয়া সাত্তার। ওয়াজেদ মেমোরিয়াল হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক, খলিলুল রহমান ডিগ্রী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকায় আসেন তিনি। পড়ালেখার সূত্রে ঢাকায় এলেও রাজনৈতিক কারণে আর পড়া হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হয়েও পরে চলে যেতে হয় নারায়নগঞ্জের সরকারি তুলারাম কলেজে। সেখানেই সম্পন্ন করেন ¯œাতক ডিগ্রি।
ব্যবসায়িক জীবনের শুরুটা ১৯৯০ সালে ঢাকার মতিঝিল ইসলামপুর থেকে। বড় ভগ্নিপতি এম বদিউজ্জামানের হাত ধরেই ব্যবসায়িক পথের যাত্রা। ১৯৯০ থেকে চলে তা ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। পাঁচ বছর শ্রম দিলেও আশানুরূপ ফলাফল আসেনি সেখানে। ব্যবসায়িক টানাপোড়নে ১৯৯৫ সালে পাড়ি জমান আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত এই দেশটিতে। প্রথম দিকের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের স্মৃতিগুলো এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠে তার। কথায় কথায় এক নিমেষেই যেন ফিরে গেলেন সেসব দিনে। বললেন, ‘১৯৯৫ সালে যখন এসেছি তখন ইনকাম ছিল না একেবারেই। অনেক কষ্ট করেছি। দিন মজুর খেটেছি। শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্যে সংগ্রাম করেছি। একদিন স্থানীয় এক আরবি ডেকে বললো তার দোকানটি চালাতে। আমি বললাম- আমার কোনো টাকা-পয়সা নাই, কিভাবে চালাব! সেই আরবি আমাকে ভরসা দিয়ে বললো, এটি তোমাকে দিয়ে দিলাম, আজ থেকে এটি তোমার দোকান।’ সেই শুরু। ওই দোকানটি চালাতেও সহযোগিতা করেন ভগ্নিপতি এম বদিউজ্জামান। পদে পদে ভগ্নিপতির সহযোগিতার কথাও স্বীকার করে গেলেন এই রেমিটেন্স যোদ্ধা। লেগে ছিলেন। নিজেকে সামনের সারিতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যতটুকু পরিশ্রম দরকার তার পুরোটাই ঢেলে দেন শফিউল ইসলাম। অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়া হলো মর্ডান লোটাস, মর্ডান লোটাস এলএলসি, মর্ডান লোটাস জেনারেল কোম্পানি এবং এসব প্রতিষ্ঠানের শাখা নিয়ে বর্তমানে রয়েছে তার ১৭টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। বিদেশের মত দেশেও রয়েছে ব্যবসায়িক ছোঁয়া। তিনি কক্সবাজার টু ডে হোটেলের গর্বিত শেয়ার পার্টনার।
পরবাসে ব্যবসার শুরুর স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, ‘আমার এতদূর আসার পেছনে বাংলাদেশের গামেন্টর্স সেক্টর খুব বেশি উপকারী বন্ধু হিসেবে পাশে ছিল। প্রথমে বঙ্গবাজার থেকে মাত্র চার কাটন মাল এনেছিলাম। এখানে বাজার ধরতে পারব দেখে পরে বিশ কাটন করে গামেন্টর্স সামগ্রী নিয়ে আসি। এভাবেই একসময় বাজার ধরি। আগামীতে দুবাইয়ের সব বড় মলে এবং বিশ্বের বড় বড় শপিং সেন্টারগুলোতে নিজের প্রতিষ্ঠান করার পরিকল্পনা তৈরি করছি।’
এই রেমিটেন্স যোদ্ধা একাধারে জড়িয়ে আছেন আমদানি-রপ্তানী ব্যবসায়। সম্প্রতি তিনি আরব আমিরাতে আমদানির ক্ষেত্রে প্রথম হয়েছেন। এই সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ আজমান মিউনিসিপালটি তাকে সম্মাননা প্রদান করে। ব্যবসায় সফল শফিউল ইসলাম তার নতুন পরিকল্পনায় রেখেছেন ফ্যাশন ডিজাইনের শো রুম ‘বিগপাল’কে ব্র্যান্ডে পরিণত করার, বাংলাদেশে হবে সেটির বড় ফ্যাক্টরি।
মোহাম্মদ শফিউল ইসলাম পলাশ একজন সংগঠক ও সমাজ সেবকও বটে। ব্যবসার পাশাপাশি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন প্রবাসী কল্যাণ সমিতির। সেই সূত্রে প্রবাসীদের ব্যবসায়িক সহযোগীতা দিতে নিজের এগিয়ে আসার কথা জানান তিনি। তার মতে, সাধারণ মানের শ্রমিকরা কায়িক পরিশ্রম করলে নিশ্চয়ই তারা সফলতা অর্জন করবে। সমাজ সেবার নিদর্শন স্বরূপ দেশে রয়েছে তার দুটি মাদ্রাসা। একটি গোপালগঞ্জের গোনাপাড়ায় অন্যটি নিজের গ্রাম গাড়ফায়। এছাড়াও বিভিন্ন মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজে নিয়মিত অনুদান রয়েছে তার।
সফল এই ব্যবসায়ী ১৯৯৪ সালে খুলনার মুন্সি পাড়ার আব্দুল হালিমের মেয়ে এলিজা ইসলামের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যবসায়িক পরিধির বাইরে ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি একজন গর্বিত পিতা। তার বড় ছেলে মিনহাজুল ইসলাম লন্ডনের লিডিং ইউনিভার্সিটি থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং সমাপ্ত করেছে ও ছোট ছেলে খৈয়ামুল ইসলাম পড়ছে ইউরোপের চেক রিপাবলিক মাজাহারিক মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত। ব্যবসার পাশাপাশি সন্তানদের সফলতার গল্প শুনে ও শুনিয়ে আগামীর দিনগুলি কাটানোর স্বপ্ন দেখেন সফল এই ব্যবসায়ী।